ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী দিবস উপলক্ষে উভয় দেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। সংগঠনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন স্বাক্ষরিত এক লিখিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আজ (৬ ডিসেম্বর ২০২৪) এই শুভেচ্ছা বার্তা প্রদান করা হয়েছে। লিখিত শুভেচ্ছা বার্তায় বলা হয়েছে যে, “ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী দিবস সমগ্র বাঙ্গালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। আজকের এইদিনে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের জনগণকে মৈত্রী দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান এদেশের জনগণ কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র প্রশিক্ষণ, কোটি কোটি শরণার্থীদেরকে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় প্রদান, স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদানসহ নানাবিধ সহযোগিতার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারতের অবদান এদেশের জনগণ আজীবন মনে রাখবে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় ভারতের লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে ভারত সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সেদিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পত্র মারফত ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি জানিয়ে দেন। এর ১০ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ দখলমুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বীর সদস্যরা। আমাদের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই ১৮ হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। দুই দেশের মানুষের রক্ত, ত্যাগ ও দৃঢ় অঙ্গীকারের ঐক্যের শক্তি বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়নের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ভারতের সেনাদের সেই আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতাকে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করেছিল।
অন্যদিকে ভারতের জনগণ বাংলাদেশের কোটি কোটি শরণার্থীর পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল তার কোনো প্রতিদান হয় না। তৎকালীন ভারতের সরকারের অবদান আমাদের মনে চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে। তাদের সেই অবদান বাঙালি জাতি কখনো ভুলে যেতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের শিকড় সেদিনই গ্রোথিত হয় যেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিধনের শিকার হয়ে বাঙালিরা ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেয়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। সেদিনই ভারতের জনগণ ও তাদের সরকার বাংলাদেশকে অলিখিতভাবে স্বীকার করে নেয়। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালিদের চরম দুর্দিনে ভারতের সরকার ও জনগণ একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত বাঙালিদের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রীর এই বন্ধন আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন দিনগুলো থেকে উদ্ভূত। এই বন্ধন শুধু দুটি দেশকেই নয়, দুই দেশের জনগণকে একত্র করেছিল। পারস্পরিক বিশ্বাস, সমঝোতা ও শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই সম্পর্ক।
দুই দেশের বীর শহীদদের মিশ্রিত রক্তধারার ওপর নির্মিত সে এক চিরস্থায়ী সম্পর্ক। তাইতো ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা সফরকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই এটিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।’ রক্ত দিয়ে গড়া সেই মৈত্রীর ভিত্তি পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক শক্তিশালী, গভীর ও সম্প্রসারিত করে। সৎ, প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যেতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর মৈত্রী দিবস পালনের এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সূত্রপাত হয়েছিল, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার এই সুযোগটি করে দেওয়ার জন্য দুই দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর তখন থেকে আর বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের দিন হিসেবেই থাকেনি, এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে গেছে দুই দেশের জনগণের মধ্যে লালিত এত দিনের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে, সেই দিনকে ‘মৈত্রী দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে।
মৈত্রী দিবস উপলক্ষে আসুন, আমরা একাত্তরের চেতনায় আবার প্রতিজ্ঞা করি, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ একসঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ব, একে অপরের সমস্যা বন্ধুত্বের অনুভূতিতে সমাধান করব এবং কাঁধে কাঁধ রেখে একসঙ্গে দুটি দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব। পৃথিবী অবাক হয়ে দেখবে দুই দেশের এই বন্ধুত্বকে। উভয়ের কল্যাণে এবং সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা মৈত্রীর সুবাতাস বয়ে যাক দুই দেশের মাটি-জল-অন্তরীক্ষে। দুই প্রতিবেশী জনগণের মধ্যে বিদ্যমান আস্থা ও বিশ্বাস সর্বদা সচল থাকুক শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী দিবস চিরজীবী হোক।