বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চার জাতীয় নেতার অবদান স্মরণীয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের দেশপ্রেম ও ত্যাগ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সফলতা সম্ভব হতো না। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে কারাগারে বন্দি থাকার সময় এই চার নেতা প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেন, ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ে অবদান রাখেন। তারা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তবে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাদের অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
মুজিবনগর সরকারের চার নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মেরুদণ্ড। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী, মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, এবং কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার ভারতীয় সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। তারা রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক দিক থেকে স্বাধীনতার ভিত্তি শক্তিশালী করেন। তাদের ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত দিকগুলো কার্যকর হওয়া কঠিন ছিল।
ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেছেন যে মুজিবনগর সরকারের প্রকৃত স্তম্ভ শুধু এই চার জনই নন, খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীও ছিলেন এই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর, তারা একটি বিতর্কিত চিত্রে পরিণত হন এবং মূলধারার সম্মান থেকে বঞ্চিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে, কিছুদিন পর তিন নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকেও হত্যা করা হয়। তাদের এই নির্মম পরিণতি বাংলাদেশে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। চার নেতার এ মৃত্যু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে দিশেহারা করে ফেলে, যা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
চার জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, এবং তার মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একসময় দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ছিলেন। মনসুর আলীর বড় ছেলে মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রী হন। কামরুজ্জামানের ছেলে এ এইচ এম খাইরুজ্জামান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই পদগুলো দেওয়া হয়েছে মূলত রাজনৈতিক পুরস্কার হিসেবে, যা চার নেতার ত্যাগ ও অবদানের প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “এটা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো, কারণ অন্যরাও তো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাই তাদের পরিবারের সদস্যদের পদে অধিষ্ঠান তাদের বাবার অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি নয়।”
চার নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কেবল সরকারি পদ দিয়েই পূর্ণ হয় না। তাদের ত্যাগ ও অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হিসেবে তাদের নামে জাতীয় স্মারক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা হতে পারত। জাতীয় স্মৃতিসৌধে তাদের আলাদা সম্মানজনক স্থান বরাদ্দ, শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের অবদানকে অন্তর্ভুক্ত করা – এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে হয়তো মূল্যায়নের প্রশ্ন উঠত না।
জাতীয় চার নেতার অবদান এবং তাদের প্রতি মূল্যায়নের প্রশ্ন সময়ের সাথে সাথে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই নেতারা শুধু মুক্তিযুদ্ধেই নন, বরং পরবর্তী বাংলাদেশের গঠনেও একটি বিশাল ভূমিকা রাখার অধিকারী ছিলেন। তাদের পরিবারের সদস্যদের পদে অধিষ্ঠান প্রশংসনীয় হলেও তাদের ত্যাগ এবং অবদানের সম্মান তখনই পূর্ণ হবে, যখন দেশের বিভিন্ন প্রজন্ম তাদের অবদান সম্পর্কে জানতে পারবে এবং জাতি তাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে রাখবে।